
প্রতিবেদক-আমিনুল ইসলাম:-
ঢাকার আশুলিয়ার শিমুলিয়া ইউনিয়নের কোণাপাড়া চিড়িংগা এলাকার শত বছরের পুরোনো একটি ঐতিহ্যবাহী সরকারি পুকুর এখন ভূমিদস্যুদের কবলে। প্রায় ১ একর ৭১ শতাংশ আয়তনের এই সরকারি জলাশয়টি দিনের পর দিন ভরাট করে গড়ে তোলা হচ্ছে বহুতল ভবন ও বাণিজ্যিক মার্কেট। অথচ এক সময় এই পুকুর ছিল এলাকার কৃষিজীবী মানুষের প্রাণ, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষাকারী একমাত্র উন্মুক্ত জলাধার এবং জরুরি মুহূর্তে ফায়ার সার্ভিসের পানির একমাত্র উৎস।
এখন সেই পুকুরের জায়গায় দখল বাজদের প্রাসাদ অবৈধ মার্কেট, বহুতল ভবন, ফ্ল্যাট ভাড়া ও দোকান ভাড়ার রমরমা ব্যবসা চলছে। অথচ এই সম্পত্তি স্পষ্টভাবে CS, SA, RS ও BRS খসড়া পর্চা রেকর্ড অনুযায়ী সরকারি খতিয়ানভুক্ত, যার মালিক ঢাকা জেলা প্রশাসন।
জলাশয় নয়, দখলের জমি এখন শতবর্ষী ঐতিহ্য আজ ধ্বংসের মুখে
স্থানীয়দের মতে, এই পুকুর ছিল কোণাপাড়ার হৃদয়। টিউবওয়েল সংকটের সময় গোসল, গৃহস্থালি কাজ, কৃষিকাজ, গবাদিপশুর পানি সবই চলতো এই পুকুরের ওপর নির্ভর করে। আশপাশের প্রায় ২-৪ গ্রামের মানুষ এই পুকুর থেকে উপকৃত হতো।
একজন বৃদ্ধ কৃষক বলেন,আমার দাদা পরদাদার আমল থেকে এই পুকুর দেখছি। এখন চারপাশে শুধু বিল্ডিং, পুকুরটা যেন হারিয়ে গেছে চোখের সামনে। আমরা চোখের জল ফেলি, সরকার দেখে না।
ভূমিদস্যুদের “মুন্সি নগর”সরকারি জমিতে প্রাসাদ কে দিল লোন?
পুকুর ভরাট করে যে আবাসিক ও বাণিজ্যিক এলাকা তৈরি করা হয়েছে, তার নাম দেওয়া হয়েছে “মুন্সি নগর”। এখানে এখন দাঁড়িয়ে আছে একের পর এক বহুতল ভবন ও দোকানপাট। অভিযোগ রয়েছে, এসব স্থাপনার বিপরীতে ব্যাংক থেকেও কোটি কোটি টাকার ঋণ নেওয়া হয়েছে।
প্রশ্ন উঠছে একটি সরকারি খতিয়ানভুক্ত পুকুরের জায়গায় কীভাবে ব্যাংক লোন দিল? ভূমি রেকর্ড যাচাই না করেই কিভাবে এসব স্থায়ী স্থাপনার অনুমোদন মিললো? ব্যাংকের ভূমিকা, ভূমি অফিসের নীরবতা এবং স্থানীয় প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা নিয়ে তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন এলাকাবাসী। দেয়ালে লেখা সরকারি সম্পত্তি কিছুদিন পরই মুছে ফেলা হয়।এলাকাবাসী জানান, কিছুদিন আগে সহকারী কমিশনার (ভূমি), আশুলিয়া সার্কেল পুকুর এলাকা পরিদর্শন করে দেয়ালে লিখে যান।এটি সরকারি সম্পত্তি, দখল দণ্ডনীয় অপরাধ।
কিন্তু ভূমিদস্যুরা সেই লেখা কয়েক দিনের মধ্যেই পালিশ করে মুছে ফেলে, এবং পুনরায় দখল ও নির্মাণ কাজ শুরু করে। এতে বোঝা যাচ্ছে, স্থানীয় দখলচক্র কতটা প্রভাবশালী এবং প্রশাসনের চোখের সামনেই কিভাবে আইন লঙ্ঘন করে যাচ্ছে। প্রতিবছর আগুন লাগে, ফায়ার সার্ভিসে পানি নেই এই পুকুর বাঁচলে জানমাল বাচেঁ।
শিমুলিয়া ও আশুলিয়া এলাকা শিল্পাঞ্চল হিসেবে পরিচিত। প্রতি বছরই গার্মেন্টস ও কারখানাগুলোতে বড় অগ্নিকাণ্ড ঘটে। কিন্তু এখন সেই আগুন নেভাতে ফায়ার সার্ভিস চরম বিপাকে পড়ে কারণ আশপাশে আর কোনো প্রাকৃতিক জলাধার অবশিষ্ট নেই। এই পুকুরটিই একমাত্র বড় জলাশয় ছিল, যা এখন ইট বালুর নিচে হারিয়ে যাচ্ছে।
ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা পানি না পেয়ে অনেক সময় তারা আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে ব্যর্থ হয়, যার ফলশ্রুতিতে ঘটে কোটি টাকার ক্ষতি, কখনো প্রাণহানিও। কৃষক-কামার-মজুরদের দুঃখ পুকুর ভরাট মানে তাদের জীবন ভরাট নয়, বরং শূন্যতা, এলাকার কৃষকরা এখন পানি সঙ্কটে হাহাকার করছেন। অনেক কৃষক বাধ্য হয়ে নলকূপ বসাচ্ছেন, কেউ কেউ ধান চাষ বাদ দিয়ে জমি পতিত রাখছেন। গৃহবধূরা বলেন,আগে পুকুরে গিয়ে গোসল করতাম, এখন অন্যের বাসার নলকূপের জন্য ধর্ণা দিতে হয়। আমাদের দিন বদল হয়নি, কেবল আশপাশে বিল্ডিং হয়েছে।জনগণের দাবি পুকুর উদ্ধার, দখলকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি
সাধারণ জনগণ একজোট হয়ে ইতিমধ্যেই ঢাকা জেলা প্রশাসকের কাছে লিখিত আবেদন করেছেন এবং পুকুরটি জরুরি ভিত্তিতে উদ্ধারের দাবি জানিয়েছেন। তাদের দাবি,সরকারি খতিয়ান ভুক্ত পুকুরটি দ্রুত দখলমুক্ত করা হোক, অবৈধ দখলদারদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হোকদখল করে গড়ে ওঠা স্থাপনা উচ্ছেদ করে পুকুরের পূর্বের রূপ ফিরিয়ে আনা হোক,সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হোক,ফায়ার সার্ভিস ও কৃষিকাজে ব্যবহারের জন্য পুকুরটি সংরক্ষণ করা হোকভবিষ্যতে যেন এমন ঘটনা না ঘটে,সেজন্য কঠোর প্রশাসনিক নজরদারি নিশ্চিত করা হোক।
একটি পুকুর,যা একসময় পুরো এলাকার জীবনজীবিকার উৎস ছিল,আজ তা ভূমিদস্যুদের লোভ আর দুর্বল প্রশাসনিক তদারকির বলি। পুকুর হারালে শুধু পানি হারায় না,হারায় ইতিহাস,সংস্কৃতি,প্রাণ ও পরিবেশের ভারসাম্য। এখন সময় এসেছে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার না হলে একদিন পুরো আশুলিয়া হয়ে উঠবে ইট-পাথরের এক নিঃশ্বাসহীন মরুভূমি।
মো.আমিনুল ইসলাম 





